পান্তা ভাত এলিট ও উচ্চবিত্তদের এক দিন কিন্তু দিনমজুরদের জন্য প্রতিদিন

পান্তা ভাত এলিট ও উচ্চবিত্তদের এক দিন কিন্তু দিনমজুরদের জন্য প্রতিদিন

গ্রাম বাংলায় এক সময় পান্তা ভাতের ব্যাপক প্রচলন ছিল। পান্তা ভাতের সাথে মরিচ ও পেঁয়াজ ছিল তার অনুষঙ্গ। কিন্তু ধীরে ধীরে গ্রাম বাংলার ঘর থেকে পান্তা ভাত খাওয়ার প্রচলন উঠে যাচ্ছে। তবে হলফ করে বলা যায় গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র পরিবারে একেবারেই যে পান্তা ভাত উঠে গেছে তা নয়।

পান্তা ভাত বাঙালির একটি জনপ্রিয় খাবার। বাঙালি মানেই ভাত প্রিয়। রাতের খাওয়ার জন্য রান্না করা ভাত, খাওয়া-দাওয়ার পর বেঁচে গেলে এটা সংরক্ষণের জন্য পানিতে ভিজিয়ে রাখত বাঙালি। পরদিন সকালে এই পানিতে চুবিয়ে রাখা ভাত খাওয়া হতো। এটাকেই পান্তা ভাত বলা হয়। গ্রাম বাংলায় পান্তা ভাত সাধারণত সকালের খাবার হিসাবে খাওয়া হয়। এটা লবণ, কাঁচা মরিচ ও পেঁয়াজ দিয়ে মাখিয়ে খাওয়া হয় । অনেকে আবার আলু ভর্তা, বেগুন ভর্তা, ডাল ভর্তা, শুঁটকি ভর্তা, সরিষার তেল, শুকনা মরিচ পোড়া ইত্যাদি দিয়ে পান্তা ভাত খেয়ে থাকে। এতে করে পান্তা ভাতের স্বাদ রুচি আরো বৃদ্ধি হয়। বাঙালি কে বলা হয়ে থাকে মাছে ভাতে বাঙালি। বাঙালি মানেই ভাত। এখন পর্যন্ত বাঙালির প্রধান খাদ্য ভাত। ইংরেজরা দুপুর ও রাতের খাবার খাওয়াকে বলে যথাক্রমে লাঞ্চ এবং ডিনার।। কিন্তু বাঙালি বলে, দুপুরের বা রাতের খাওয়া মানেই ভাত। অর্থাৎ ভাত এতটাই গুরুত্বপূর্ণ আমাদের জীবনে। এটা মূলত রাতের বেলা বেঁচে যাওয়া ভাতকে পানিতে চুবিয়ে রেখে পান্তা ভাত তৈরি করা হয়। তবে অনেকে সকাল বেলার পাশাপাশি ভরদুপুরে পান্তা ভাত খেতে পছন্দ করে। কেননা পান্তা ভাত খেলে শরীরে এক ধরনের শীতল ভাব আসে। খুব প্রশান্তি লাগে।

পান্তা ভাতের এই ইতিহাসকে আঁকড়ে রাখার জন্য মোগল সম্রাট আকবরের তৈরিকৃত বর্ষপঞ্জির প্রতি নববর্ষের প্রথম দিনে পান্তা ভাত ও ইলিশ মাছ খাওয়া হয়। যদিও বাংলাদেশের সকল মানুষের ইলিশ মাছ খাওয়ার সামর্থ্য নেই। তবুও বাংলাদেশের এলিট ও উচ্চমধ্যবিত্ত সম্প্রদায় এই সংস্কৃতিকে জিইয়ে রেখেছে। যদিও তারা বছরের একটা দিনই এটার চর্চা করে। বছরের অন্যান্য সময় পান্তা ভাত দেখলে নাক সিটকায়।

পান্তা ভাত যে একদম পুষ্টিহীন তা কিন্তু নয়। এটার মধ্যেও বেশ কিছু পুষ্টি রয়েছে। পান্তা ভাতের পুষ্টিমান হলো— ক্যালোরি ১০০ থেকে ১৩০ কিলো জুল, কার্বোহাইড্রেট ২৫ থেকে ৩০ গ্রাম, প্রোটিন ২ থেকে ৩ গ্রাম, ফ্যাট ০.২ – ০.৫ গ্রাম, ফাইবার ০.৫ – ১ গ্রাম, ভিটামিন বি১ ০.২ মিলি গ্রাম, ভিটামিন বি২ ০.৩ মিলি গ্রাম, ভিটামিন বি৩ ০.৬ মিলি গ্রাম, ভিটামিন বি৬ ০.১ মিলি গ্রাম, আইরন ০.২ – ০.৪ মিলি গ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম ১০ – ২০ মিলি গ্রাম, পটাসিয়াম ১৫ – ৩০ মিলি গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৫ – ১০ মিলি গ্রাম, ফসফরাস ৪০ মিলি গ্রাম, জিংক ০.৬ মিলি গ্রাম।

পান্তা ভাত খাওয়ার ফলে বেশ কয়েকটি উপকারিতা পাওয়া যায়, বিশেষ করে এটি বাংলাদেশের মতো গরম আবহাওয়ার দেশে জনপ্রিয়। পান্তা ভাতের উপকারিতা গুলো— প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ: পান্তা ভাতে প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া থাকে যা অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়ক। এটি হজম প্রক্রিয়াকে উন্নত করে এবং গ্যাস্ট্রিক সমস্যার ঝুঁকি কমায়। অ্যাসিডিটির সমস্যায় উপশমকারী: পান্তা ভাত অম্লতা কমাতে সাহায্য করে, তাই অ্যাসিডিটি বা পেটের অস্বস্তি থাকলে এটি উপকারী হতে পারে। গরম আবহাওয়ায় আরামদায়ক: গরমের সময় পান্তা ভাত শরীরকে ঠান্ডা রাখে এবং তাপজনিত সমস্যা থেকে রক্ষা করে। এটি শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ: পান্তা ভাত কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ, যা শরীরে দ্রুত শক্তি যোগায়। এটি দীর্ঘক্ষণ সময় কাজ করার শক্তি সরবরাহ করতে সহায়ক। ভিটামিন ও খনিজের শোষণ বৃদ্ধি: পান্তা ভাতের ফারমেন্টেশন প্রক্রিয়ার ফলে ভিটামিন বি গ্রুপের কিছু পরিমাণ এবং মিনারেলগুলির শোষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে শরীর সহজেই পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে। পান্তা ভাতের পানির সাথে পুষ্টি: পান্তা ভাত খেলে শরীরে পানি এবং কিছু পুষ্টি সরাসরি পৌঁছায়, যা ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধ করতে সহায়ক। বিশেষ করে গরমের সময় বা বেশি ঘাম হলে এটি উপকারী। প্রোবায়োটিক এর ভূমিকা: প্রোবায়োটিক এর উপস্থিতি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়ক। এটি শরীরকে বিভিন্ন সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। আয়রন: পান্তা ভাতের মধ্যে থাকা আইরন মানুষের দেহের রক্তে লৌহ কণিকা বৃদ্ধি করে। ফলে মস্তিষ্কে বেশি পরিমাণে রক্ত প্রবেশ করে এবং মস্তিষ্ক সুস্থ থাকে। সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী: পান্তা ভাত সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী খাবার, যা গ্রামের মানুষদের জন্য বিশেষ করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক। এটি পুষ্টির সহজ উৎস হতে পারে। পান্তা ভাত স্বাস্থ্যকর খাদ্য হিসেবে পরিচিত, বিশেষ করে গরম আবহাওয়ায়। এটি সহজলভ্য, পুষ্টিকর এবং পরিপাকতন্ত্রের জন্য উপকারী। তবে, এটিকে দীর্ঘ সময়ের জন্য ফেলে না রেখে সতর্কতার সাথে খাওয়া উচিত যাতে খাদ্যজনিত অসুস্থতা এড়ানো যায়। পান্তা ভাত খাওয়া সাধারণত নিরাপদ এবং আরও কিছু স্বাস্থ্যগত উপকারিতা প্রদান করে। তবে কিছু পরিস্থিতিতে এবং কিছু লোকের জন্য পান্তা ভাত খাওয়া ক্ষতিকর হতে পারে।

পান্তা ভাত খাওয়ার সম্ভাব্য ক্ষতিকর দিকগুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো— ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ: পান্তা ভাত দীর্ঘ সময় বাইরে রেখে দিলে বা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হলে এতে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি পেতে পারে। এই ধরনের ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ঘটিয়ে ফুড পয়জনিংয়ের কারণ হতে পারে। স্টেফাইলোকক্কাস অরিয়াস (Staphylococcus aureus): এই ব্যাকটেরিয়া সহজেই পান্তা ভাতে বৃদ্ধি পেতে পারে এবং তা খাদ্যে বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে। স্বল্প পুষ্টিমান: পান্তা ভাত পুষ্টিগুণে খুব বেশি সমৃদ্ধ নয়। এটি প্রধানত কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ, তবে প্রোটিন, ভিটামিন, এবং খনিজের পরিমাণ কম। দীর্ঘ সময় পান্তা ভাত খেলে পুষ্টির অভাব দেখা দিতে পারে। ভিটামিন বি১২ এর অভাব: যেহেতু ভিটামিন বি১২ মূলত প্রাণিজ উৎস থেকে আসে, তাই শুধু পান্তা ভাত খেলে এই ভিটামিনের ঘাটতি হতে পারে, যা অ্যানিমিয়া এবং স্নায়বিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। লবণের অতিরিক্ত ব্যবহার: পান্তা ভাত খাওয়ার সময় অনেকে অতিরিক্ত লবণ ব্যবহার করে থাকেন, যা উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। অতিরিক্ত অ্যাসিড: কিছু মানুষ পান্তা ভাত খাওয়ার পর অতিরিক্ত অ্যাসিডিটির সমস্যা অনুভব করতে পারেন, বিশেষ করে যাদের গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আছে। পান্তা ভাতের ফারমেন্টেশনের কারণে এর অ্যাসিডিক স্তর বৃদ্ধি পায়, যা অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারে। অ্যাসিডিক প্রকৃতি: পান্তা ভাতের ফারমেন্টেশনের ফলে তৈরি হওয়া অ্যাসিড দাঁতের এনামেল ক্ষয় করতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে দাঁতের ক্ষতি করতে পারে। প্রোটিনের ঘাটতি: পান্তা ভাত প্রোটিনে কম, তাই যারা উচ্চ শক্তি প্রয়োজনের কাজ করেন বা শরীরচর্চা করেন, তাদের জন্য এটি যথেষ্ট শক্তি সরবরাহ করতে পারে না। এটি শারীরিক দুর্বলতা বা ক্লান্তি বাড়াতে পারে। ১২ ঘণ্টারও বেশি সময় ভাতের ফারমেন্টেশন হলে অর্থাৎ পানিতে ভাত চুবিয়ে রাখলে, সেখানে অ্যালকোহলের উপাদান তৈরি হয়। অতঃপর সেই পান্তা ভাত খেলে পরে শরীর ম্যাজ ম্যাজ করে এবং ঘুম পায়।

যদি পান্তা ভাত পরিষ্কার পাত্রে বিশুদ্ধ পানি দ্বারা তৈরি করা না হয়, তাহলে সেখানে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া তৈরি হতে পারে। সেই ভাত খেলে মানুষ অসুস্থ হয়ে যাবে। মারাত্মক খাদ্যে বিষক্রিয়া হতে পারে। তবে পান্তা ভাত সাধারণত সবার জন্য নিরাপদ এবং উপকারী হলেও কিছু মানুষ বা পরিস্থিতিতে এটি খেলে কিছু ঝুঁকি থাকতে পারে। তাই পান্তা ভাত খাওয়ার সময় পরিষ্কার এবং স্বাস্থ্যকরভাবে সংরক্ষণ করা, সংরক্ষণ করা এবং পরিমিতভাবে খাওয়া উচিত। বিশেষ করে যদি এটি দীর্ঘ সময় বাইরে রাখা হয়, তবে তা খাবার আগে সতর্ক হতে হবে।

শত পরিবর্তন ঘটার পরেও বাঙালি সেই ভাত প্রিয় রয়েই গেছে। এখনো পান্তা ভাত খায় এই বাঙালি। কিন্তু বর্তমানে পান্তা ভাত খাওয়াকে নীচু চোখে দেখা হয়। অপরদিকে জাঙ্ক ফুডগুলোকে আদর্শ মনে করা হয়। আমাদের খাদ্য, আমাদের সংস্কৃতি কেবল পেটের তৃপ্তির মাধ্যম নয়, এটি আমাদের পরিচয়ের প্রতিচ্ছবি। একইসঙ্গে, এই খাবারগুলো আমাদের সংস্কৃতির সাথে গভীরভাবে জড়িত এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তা সংরক্ষিত ও প্রভাবিত হয়েছে। খাদ্য শুধু শারীরিক পুষ্টির জোগান দেয় না; এটি আমাদের আবেগ, ঐতিহ্য এবং ঐক্যের প্রতীক হিসেবেও কাজ করে।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password