চান্দ্রজগৎ

চান্দ্রজগৎ

এক.

বিজ্ঞান পরিষদের সুবিশাল হলঘরে জড়ো হয়েছেন জ্যোতির্বিদেরা। তাক লাগানো রকমারি বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিতে সজ্জিত হলরুমটা।

খানিক পরই ওখানে এসে উপস্থিত হলেন পরিষদের প্রেসিডেন্ট প্রফেসর বারবাফুলি ও কমিটির অন্য সদস্যরা।

বিশাল কনফারেন্স টেবিলে আসন গ্রহণ করলেন সবাই।

সহকর্মীদের ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট্ট একটি ভূমিকার পর নিজের পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন প্রফেসর।

বেশির ভাগই সমর্থন করলেন তাকে। শুধু একজন তুললেন প্রবল আপত্তি।

ব্যস, শুরু হয়ে গেল তর্কের ঢেউ! শুরুতে চুপচাপ ছিলেন যারা, তারাও এখন শুরু করেছেন বিরুদ্ধাচরণ।

কোনোভাবেই তাদের বাগ মানাতে না পেরে রেগেমেগে গবেষণার কাগজপত্র ছুড়ে ফেললেন বিজ্ঞানীপ্রধান।

গোলমাল একটু কমলে সিদ্ধান্ত হলো, ভোটাভুটি হবে।

শেষমেশ অবশ্য দেখা গেল, প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবিত চন্দ্রাভিযানের পক্ষেই ভোট পড়েছে বেশি।

নস্ট্রাডামুস, অ্যালকোফ্রিসবাস, ওমেগা, মাইক্রোমেগাস ও প্যারাফ্যারাগামুস—এই পাঁচজনের সম্মতিক্রমে নিজের সফরসঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করলেন তাঁদের বারবাফুলি। সেদিনের মতো সমাপ্ত হলো সভা।

লক্ষ্য ঠিক হয়েছে, অভিযানের আড়ম্বরপূর্ণ প্রস্তুতির সূচনা হলো এবার।

কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে চলেছেন নানান পেশার কারিগরেরা। দম ফেলার সময় নেই কারও। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, শেষ করা চাই আকাশযান নির্মাণের দক্ষযজ্ঞ।

কাজের অগ্রগতি দেখার জন্য একদিন ওয়ার্কশপ পরিদর্শন করলেন পরিষদের সভ্যরা। গিয়ে দেখেন এলাহি কারবার! রীতিমতো মহাযজ্ঞ চলছে সুপরিসর খোলা জায়গাজুড়ে। একাধিক চুল্লি থেকে গলিত ইস্পাত ঢালা হচ্ছে নানা ধরনের ছাঁচের মধ্যে। নীল আকাশের পটভূমিতে গলগল করে ধোঁয়া ওগড়াচ্ছে সারি সারি চিমনি। দেখেশুনে উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটতে লাগলেন পরিদর্শকেরা।

সুবিধামতো জায়গায় স্থাপন করা হলো সদ্য নির্মিত প্রমাণ সাইজের কামানটি। তুমুল করতালি ও হর্ষধ্বনির মধ্যে নির্দিষ্ট দিন রঙ্গমঞ্চে পদধূলি দিলেন ট্র্যাভেলিং স্যুট পরা প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পাঁচ সঙ্গী। পতপত করে উড়ছে পতাকা। হাত নাড়লেন তাঁরা দর্শকদের অভিনন্দনের জবাবে।

দুই.

উচ্ছ্বসিত জ্যোতির্বিদেরা সন্তর্পণে বেরিয়ে এলেন তাঁদের বহনকারী আকাশযানটি থেকে।

অবশেষে চাঁদের মাটি স্পর্শ করেছে রকেট!

সম্পূর্ণ নতুন, সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশ! বিচিত্র আলোয় উদ্ভাসিত চারপাশ।

দিগন্তে দেখা যাচ্ছে, ধীরে ধীরে আকাশে উদিত হচ্ছে পৃথিবী!

সৌরজগতের তৃতীয় গ্রহের একমাত্র উপগ্রহের জমিনের জায়গায় জায়গায় ভয়জাগানিয়া গর্ত। আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ ওগুলো! থেকে থেকে ‘ভুম’ করে উদ্‌গিরিত হচ্ছে ধোঁয়ার ফোয়ারা।

শুরু হলো পৃথিবীবাসীর চাঁদের বুকে পদচারণ।

অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরির পর ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে লম্বা হলেন তাঁরা উন্মুক্ত প্রান্তরেই। সারা দিনের উত্তেজনার পরমুহূর্তেই ঢলে পড়লেন নিদ্রাদেবীর কোলে।

একপর্যায়ে সপ্তর্ষিমণ্ডল দেখা দিল আকাশে। তারপর একসময় বলয়ঘেরা শনিগ্রহ জায়গা নিল সাত নক্ষত্রের।

রাত আরও গভীর হলে শুরু হলো ঝিরিঝিরি তুষারবৃষ্টি। চরাচর ঢেকে দিতে লাগল শুভ্র চাদরে।

কাঁপতে কাঁপতে ঘুম ভাঙল হতবিহ্বল অভিযাত্রীদের।

ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচতে সিদ্ধান্ত নিলেন তারা, নামবেন জ্বালামুখের ভেতর! মহাবিপদের আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও।

অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। একে একে রকেট আকৃতির গোলার মধ্যে প্রবেশ করলেন ছয় অভিযাত্রী। বন্ধ হয়ে গেল রকেটের দরজা।

কজন গোলন্দাজ এবার কামানের মুখ দিয়ে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল গোলাটা।

উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে সবাই, নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তা কাঙ্ক্ষিত সংকেত দিতেই ‘ধুড়ুম’ আওয়াজে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হলো কামানের গোলা।

ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচতে সিদ্ধান্ত নিলেন তারা, নামবেন জ্বালামুখের ভেতর! মহাবিপদের আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও

নামতে নামতে পাতালের আজব এক গুহায় এসে হাজির হলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। জাত-বেজাতের প্রকাণ্ড সব মাশরুম চারদিকে! সঙ্গে থাকা ছাতাটা খুললেন একজন, ওটার সঙ্গে মাশরুমগুলোর আকারের তুলনা করতে।

আচমকা মানুষের মতো দেখতে কিম্ভূত এক প্রাণী উদয় হলো মাশরুমের দঙ্গল থেকে। বানরের মতো লাফঝাঁপ করছে সমানে।

সেলেনাইট এরা। চাঁদের বাসিন্দা।

তিড়িংবিড়িং করতে করতে এক অভিযাত্রীর দিকে ধেয়ে গেল প্রাণীটি।

নিজেকে রক্ষার তাগিদে হাতের ছাতা দিয়ে ঘা বসিয়ে দিলেন বিজ্ঞানী। ওমা! এক আঘাতেই সহস্র টুকরা হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেল চাঁদের প্রাণী।

দ্বিতীয় আরেকটি সেলেনাইটের আবির্ভাব ঘটলে সেটারও পরিণতি হলো একই।

কিন্তু তারপরই ঝাঁকে ঝাঁকে বেরোতে লাগল সেলেনাইটরা!

মরণপণ লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়লেন আতঙ্কিত বিজ্ঞানীরা।

বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না লড়াইটা। চন্দ্রবাসীদের সংখ্যাধিক্যের কাছে নতিস্বীকার করতে হলো চাঁদে অনুপ্রবেশকারীদের।

ধরে নিয়ে যাওয়া হলো তাঁদের সেলেনাইটদের রাজার কাছে।

নিজের প্রাসাদে, তারকাখচিত সিংহাসনে বসে আছে রাজামশাই।

কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই বারবাফুলি তিরবেগে ছুটে গেলেন তার দিকে। পালকের মতো হালকা সম্রাটকে দুই হাতে তুলে ফেললেন রাজকীয় আসন থেকে, পরক্ষণে সর্বশক্তিতে আছড়ে ফেললেন মেঝেতে!

বিকট আওয়াজে বিস্ফোরিত হলেন রাজা!

ঘটনার আকস্মিকতায় স্থাণু হয়ে গেছে সেলেনাইটরা। এরই সুযোগে সঙ্গীদের নিয়ে ছুট লাগালেন প্রেসিডেন্ট বারবাফুলি। সংবিৎ ফিরে পেয়ে সেলেনাইট বাহিনী ধাওয়া দিল তাঁদের।

যখনই কাছাকাছি চলে আসছে, বাউলি কেটে আরেক দিকে সরে যাচ্ছেন আকাশচারীরা। কায়দামতো পেলে ছাতার বাড়ি মেরে কমিয়ে আনছেন ভঙ্গুর জীবগুলোর সংখ্যা।

এই কানামাছির মধ্যেই পৌঁছে গেলেন রকেটটির কাছে। মুহূর্তমাত্র দেরি না করে সেঁধোলেন ওটার পেটের মধ্যে।

বিকল্প ব্যবস্থায় আকাশে উঠল মহাশূন্যযান। ঘরের ছেলেরা ফিরে চলেছেন ঘরে।

তিন.

পতনের ধাক্কায় ডুবে গিয়েছিল, ভেতরে আবদ্ধ বাতাসের কারণে ভারসাম্য বজায় রেখে ধীরে-সুস্থে জলসমতলে ভেসে উঠল রকেটটি। সাগরে ল্যান্ড করেছে ওটা।

নৌবাহিনীর স্টিমার এসে তুলে নিল চন্দ্রফেরত অভিযাত্রীদের। ফিরে চলল বন্দরের দিকে। সেখানে তাঁদের সংবর্ধনা জানাতে অপেক্ষা করছে সমস্ত শ্রেণি-পেশার মানুষ।

সহি–সালামতে ফিরতে পারায় অভিযাত্রী দলকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানালেন নগরপিতা। ‘অর্ডার অব দ্য মুন’ পদকে ভূষিত করা হলো দলের প্রত্যেককে। সম্মান দেখানো হলো কুচকাওয়াজের মাধ্যমে।

প্রেসিডেন্ট বারবাফুলির আলিশান এক স্ট্যাচু স্থাপন করা হয়েছে নগরীর ব্যস্ত চৌরাস্তায়। দলে দলে সমবেত হলো সবাই ভাস্কর্যটি ঘিরে। বেজে উঠল ব্যান্ড পার্টির বাজনা। নাচগানে আত্মহারা হলো নগরবাসী। তাদের তো বটেই, সমগ্র পৃথিবীবাসীরই আজ আনন্দের দিন!

জুল ভার্ন: বিখ্যাত লেখক, বিজ্ঞান কল্পকাহিনির জনক বলা হয় যাঁদের, তাঁদের মধ্যে তিনি অন্যতম। ১৮২৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সের নানতেস শহরে জন্মগ্রহণ করেন জুল ভার্ন। সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা লেখক তিনি, তাঁর কল্পনাশক্তি ছিল অভাবনীয়। মানুষ চাঁদে পৌঁছানোর বহু বছর আগেই তিনি লিখেছিলেন চাঁদে অভিযানের গল্প। সাবমেরিন আবিষ্কারের অনেক আগে জুল ভার্নের উপন্যাসে ভেসেছে সাবমেরিন, যা সত্যিই বিস্ময়কর। অসংখ্য বইয়ের মধ্যে আশি দিনে বিশ্ব ভ্রমণ, টোয়েন্টি থাউজেন্ডস লিগস আন্ডার দ্য সি, চাঁদে অভিযান, রহস্যময় দ্বীপ উল্লেখযোগ্য। ১৯০৫ সালের ২৪ মার্চ মারা যান এই বিখ্যাত সাহিত্যিক।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password