অভিলাষ

অভিলাষ

(এক)

- আঃ, ভারী বিরক্ত করিস তুই।

বিরক্তিটা গলায় যথাসম্ভব ফুটিয়ে তুলে বলি আমি, কমফর্টারটা আর একটু ভাল করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে। মার্চ পড়ে গেলেও, আজ গুগল ওয়েদারে পনেরো দেখাচ্ছে। সপ্তার সবেধন নীলমণি রোব্বার। এইমাত্র টেবিল-ক্লকটা কাঁপতে কাঁপতে আড়াইটের অ্যালার্ম বাজিয়ে শান্ত হয়েছে। আকাশের যা অবস্থা তাতে যেকোন সময় হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামবে। সেমেস্টার পরীক্ষাও নেই ঘাড়ের ওপর। এইবেলা এমন তুরীয় আমেজে কোথায় মজাসে ভাতঘুম দেবো তা নয় চলো গল্প মারাতে! কেন? না সাড়ে ছটায় তো পাঞ্চালীদির ফ্লাইট আছে রে বিকেলের দিকে খুব একটা সুবিধে হবে না! ধ্যাস্টামো যতসব।

- বেশ তো। তুই হ্যাঁ বলে দে। আমি আর একটুও বিরক্ত করব না। চাপা হাসির শব্দ পাওয়া গেল কি?

- না-না-না! কতবার বলব কাল গটের পুরো সীজ্নটা দেখে শুতে গিয়েছিলাম। ঘুম হয়নি ঠিকমত। তার ওপর আজ সকালে আজ সকালে সুমিত্রামাসি এসেছিল তাতাইকে নিয়ে। মহা বিচ্ছু ছেলে। ঘরময় দাপিয়ে বেড়িয়ে মাথা ধরিয়ে দিয়েছে। এখন একটু না ঘুমোলে আমি জাস্ট মরে যাব!

একটানে মিথ্যেগুলো বলে একটু থামতে হল। দম নেওয়ার জন্য। হ্যাঁ, বুঝলাম যে পাঞ্চালীদি আজ ক্যানাডা চলে যাচ্ছে। কিন্তু আদিখ্যেতাটা কি এবার বেশিই হয়ে যাচ্ছে না। বিশেষত এইসময় ওনার প্যাকিং নিয়ে ব্যস্ত থাকাই স্বাভাবিক। আমরা সরাসরি এয়ারপোর্টে সী-অফ করতে গেলেই তো চলে। চার ঘন্টা আগে থেকে তাঁর বাসায় গিয়ে চক্ষু-ছলছল ন্যাকামি ফলিয়ে কোন চতুর্বর্গটা লাভ হবে! তার ওপর, বস্তুত সবার ওপর, আজকের ওয়েদারে! কলকাতাবাসী এইরকম দিন কটা দেখেছে হাতে গুনে বলে দেওয়া যায়।

পাঞ্চালীদিকে মৈনাকের ফেসবুকতুতো দিদি বলা চলে। উনি মৈনাকের লেখালেখির বেজায় ভক্ত। এবং সেই সূত্রে আমার সাথে পরিচয়। মৈনাকই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল - সেও প্রায় বছরখানেক হবে।

পাঞ্চালীদি মানে পাঞ্চালী মৈত্র। যাদবপুরে কম্পারেটিভ লিটারেচারের অধ্যাপিকা। বয়স যা মনে হয় - পঁয়ত্রিশের সামান্য ওপরে। অসামান্যা সুন্দরী। ব্যাক্তিত্বময়ী। সবথেকে বড় গুন - ভদ্রমহিলার তুখোড় রান্নার হাত। বছর-ছয়েক হল মিউচ্যুয়ালি সেপারেটেড। সায়ন্তনদা থাকে ফ্লোরিডাতে। ফলে পাঞ্চালীদির ফ্ল্যাটটাকে আমরা সেকেন্ড হোম বানিয়ে ফেলেছি। আর, রন্ধনশিল্পের এমন উপযুক্ত সমঝদার পেলে কোন শিল্পীই বা অখুশি হয়! মৈনাক অবশ্য আমায় খোঁটা দিতে ছাড়ে না। বলে- আমি না হয় হস্টেলের ভুক্তভোগী, আমার মাঝে-সাঝে মুখ পাল্টানোটা জায়েজ। তা বলে তুইও হ্যাংলার মতো চলে আসবি? আমিও ছেড়ে কথা বলি না- তাই বুঝি? আমার তো ধারনা মুখ পাল্টানোর দরকার পড়লেই তুই কেবল হস্টেলে যাস!

- বেশ। পরে কিন্তু, নিয়ে যেতে সাধা হয় নি মর্মে হ্যাজ দিস না। আর হ্যাঁ ভালো কথা; পাঞ্চালীদি তোর জন্য একটা বই আনিয়ে রেখেছে বলছিল। ভ্যান গখের কমপ্লিট ওয়ার্কস না কী যেন! যাক, আজ যখন তোর ইচ্ছে নেই তখন পরেরবার উনি কলকাতায় ফিরলেই নাহয় নিয়ে আসিস গিয়ে টিংটিং-টিংটিং!

ফোনটা কেটে দিল! সত্যি, শয়তান কতরকমের হয়!

ঘুম যে আর আসবে না বলাই বাহুল্য। ঘন্টাদুয়েক বিছানায় এপাশ ওপাশ গড়িয়েই গেলাম খালি আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে।

- ব্যাটা চাল মেরেছে নির্ঘাত।
- ধুর মৈনাক তো তেমন একটা খিল্লিবাজ না। বরং মাঝে-মাঝে সিরিয়াসনেসের বহর দেখলে ডিপ্রেশনের রুগী সন্দেহ হয় দস্তুরমতো! তাহলে?
- চলেই যাই। পাঞ্চালীদি আবার কবে দেশে ফিরবে!
- ছিঃ এতক্ষন পরে কিনা! পাক্কা লোভী ভাববে।
- ভাবুক!
- গিয়ে কী বলবি?
- কী আবার? মাথা ধরা সেরে গেল!
- বাঃ! যদি বলে ধুত্তোর ছাই বলবে! পাঞ্চালীদি মোটেও অমন নয়!

অতএব এক লাফে খাট থেকে নেমে সোজা ওয়াশরুমে। ফেসওয়াশটা হাতে নিয়ে ভাবলাম - মেট্রো নিয়ে নেবো। তাড়াতাড়ি হবে।

(দুই)

দুপুরের দিকটায় মেট্রোগুলো বেশ খালি লাগে। উমম্ খালি না, ফাঁকা ফাঁকা। সকালের মতো উপচে পড়া ভিড়টা অন্তত থাকে না। সেইটেই স্বাভাবিক। স্কুল-কলেজ-অফিস। ক্রিকেট-বলিউড-পলিটিক্স বসে গেলে দেশের আর থাকল টা কী! তাছাড়া, দিনের শুরুতে লোকজনের উদ্যমও থাকে বেশি। গুঁতোগুঁতি হয় সেয়ানে সেয়ানে। বিকেলে ঘরমুখী ভিড়টা বড্ড শ্রান্ত, এলিয়ে পড়া।

আমাদের দেশের আর পাঁচটা পাব্লিক ট্রান্সপোর্টের থেকে মেট্রো খানিকটা স্বতন্ত্র। তার শৃঙ্খলাবদ্ধ পরিছন্ন ছিমছাম ভাবমূর্তিটি যেন রাশভারী থানধারী রাঙা-পিসিমা। যাঁর কড়াচোখের দিকে নজর গেলে আপ্সেই মনে পড়ে যায় - আরে তাইতো ঠাকুরঘরে ঢোকার আগে জুতোজোড়া খুলে রাখতে হবে যে! মানে, হাওড়া-ব্যান্ডেল লোকালে থ্রি-সিটারের চতুর্থ সহযাত্রীটিকে অবলীলায় গলা ভারী করে একটু চেপে বসুন তো দাদা, অনেক জায়গা আছে বলাটা আপনার সংবিধানসিদ্ধ অধিকার। ঠেকাচ্ছে কে? কিন্তু যেই একবার পাতালরেলের টানেলে সেঁধিয়েছেন অম্নি আপনিই বেজায় সভ্যতা-সচেতন হয়ে অ্যাডজাস্ট শব্দটি অভিধান থেকে স্রেফ ধাঁ মুছে ফেলবেন!

ফার্স্ট ইয়ারে যখন দমদমে মেস নিয়ে থাকতাম তখন কলেজ আসবার সময় রোজ সকালে, রেগুলার মেট্রোযাত্রী-দের এই রঙ্গ ফ্রি-তে দেখার সুযোগ মিলত। প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢুকলেই, সারিবদ্ধ এলিট যাত্রীগণ ভদ্রতা বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা নিয়ে সিটে বসার জন্য যে প্রতিযোগিতা করতেন তাতে হাসি চেপে রাখা বেশ দুঃস্কর।

তার ওপর আজ আবার রবিবার। এবং আকাশের এই অবস্থা। কজেই মেঘার যে মাথা ধরবে সে আর আশ্চর্য কি! তবে তুরুপের টেক্কাটি যেভাবে ফেলেছি তাতে করে ওকে গেঁথে ফেলা খুব একটা কঠিন হবে না। ভ্যান গখ্ মেঘার প্রফেটসম। আমাদের রিলেশনশিপের এক বছর উপলক্ষে চ্যাপলিনের ব্রিলিয়ান্ট একটা পোর্ট্রেট গিফ্ট করেছিল ও। অথচ, তার আগে পর্যন্ত ঘুনাক্ষরেও কোনোদিন টের পেতে দেয়নি যে পেইন্টিং এর ওপর ওর এত ঝাঁঝালো প্যাশন। এত ভালো ছবি আঁকে মেয়েটা যে, অনায়াসে প্রফেশনাল হতে পারে। এনি ডে। অথচ কোনোদিন কলেজ স্যোশালে কম্পিট করত না। জিজ্ঞেস করলে বলবে, প্রতিযোগিতা খুব বাজে জিনিস। আমার হারতে ভাল্লাগে না ব্যাস! আরে!

ওকে বলেছিলাম, যেদিন মাসিমার সাথে আমার আলাপ করিয়ে দিবি আমি নিশ্চিত একহাত নেবো দেখে নিস, মেয়েকে আর্ট কলেজে না পাঠিয়ে মেডিকেল কলেজে পাঠালেন বলে। ও হেসে দিয়েছিল, আহা, তাহলে তো আর তোর সাথে দেখা হত না কোনোদিন!

ফোনালাপ অবশ্য যেভাবে শেষ হয়েছে তাতে অন্য কেউ হলে, এরপর ইউ টার্ন এর কথা ভাবতেও পারত না। কিন্তু আমি নিশ্চিত ও আসবেই। পাতি চক্ষুলজ্জা দেখিয়ে ভ্যান গখ ছেড়ে দেবো এমন দপদপে ইগো আমার চিরকালই আছে। ওর নেভার। এছাড়াও, আমার আরও অনেক মহৎ গুণাবলীই ওর নেই!

ও ভীষণ রকম প্রাণোচ্ছল। যেকোন কারোর সাথে দেড় মিনিটে বন্ধুত্ব করে নিতে পারে। যেকোন আড্ডা মাতিয়ে রাখার ব্যতিক্রমী প্রতিভা নিয়ে গজিয়েছে। সেখানে আমি - আপাদমমস্তক কমপ্লিকেটেড একটি স্ট্রিং থিয়োরি। সহজ সমাধানটা চোখে পড়ে সব্বার শেষে। একসাথে তিনজন দেখলেই ভিড় মনে হয়। সবার থেকে পালিয়ে পালিয়ে, ক্যান্টিনের এক কোনে গল্পের বইয়ে মুখ গুঁজে বাঁচি। এটা যে খুব গৌরবের মনে করি তাও নয়। অথচ আমি, যাকে বলে মুখচোরা, একেবারেই নই। আমার আসলে, প্রচলিত সামাজিক আদবকায়দা-গুলো এতোটাই কিম্ভূত লাগে যে রপ্ত করতেই কেমন জানি ঠেকে! ফলে কিছুতেই আর সবার সাথে মিশে উঠতে পারি না। বিশেষত আমার নিজের জেনারেশনের। বা, আরও সঠিক করে বললে, আজ অব্দি যাদের সাথে খোলামেলা মিশতে পেরেছি, তাদের সংখ্যা কিছুতেই টু ডিজিটে যেতে পারে না!

মেঘাকে দেখে হিংসেও কম হয় না। মাঝে মাঝে ভাবি এই বিচ্ছিরি পৃথিবীতে একটা হোমো স্যাপিয়েন্স এত হাসিখুশি থাকে কীভাবে! কলেজের বাইরেও অনেকেই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করেছে আমাদের, এই অসহ্য বৈপরীত্য নিয়ে সম্পর্কটা তিন বছর টিকে গেল কোন মন্ত্রে? আমি হাঁইমাই করে তেড়ে ওঠার আগে মেঘাই হেসে কাটিয়ে দিয়েছে সেসব - বিপরীত মেরুদ্বয়ের মধ্যেই আকর্ষণের নিয়ম মশাই।

পরবর্তী স্টেশন- নেতাজী ভবন; প্ল্যাটফর্ম ডানদিকে আগলা স্টেশন- নেতাজী ভাওয়ান; প্ল্যাটফর্ম ডাহিনে তরফ দ্যা নেক্সট স্টেশন- নেতাজী ভাবন; দ্যা প্ল্যাটফর্ম ইজ অন দ্যা রাইট সাইড!

চিন্তাসূত্র ছিন্ন হল যান্ত্রিক ঘোষণায়। আমি সিট ছেড়ে উঠে গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। স্টেশন থেকে তিন মিনিট মতো হেঁটে নবনীড় কমপ্লেক্স। ওখানেই পাঞ্চালীদির ডেরা।

পাঞ্চালীদির সাথে আলাপ হয়েছিল গতবছর বইমেলায়। সেও ভারী মজার গল্প। সারা বিকেল গোটা মেলা চষে বেড়িয়ে বই ঘাঁটাঘাঁটি পর্ব শেষ। ফেরার আগে কোন একটা স্টলে যেন বেশ কাউন্টারে গিয়ে বলেছি- হিমু সমগ্র সেকেন্ড পার্টটা বিল করে দেবেন প্লিজ্।

- কোনটা? হুমায়ূন আহমেদের?

- আপনাদের কাছে আর কটা হিমু আছে সুধীরদা? পিছন থেকে এক মধ্যবয়সী সুবেশী ভদ্রমহিলা হাসতে হাসতে এগিয়ে এলেন। উমম্ মধ্যবয়সী সেভাবে নয়, বিগতযৌবনা-ও ঠিক যায় না। মধ্যযৌবনা বলা যেতে পারে হয়ত! নিঃসন্দেহে সুন্দরী। সে সৌন্দর্যে বসন্তের ধাঁধানো তীব্রতা নেই, আছে হেমন্তের স্নিগ্ধতা।

- আরে ম্যাডাম যে ভালো আছেন তো? এই বছর আপনার প্রবন্ধ-সংকলনটা বেরোবার কথা ছিল না? আমাদেরও কিছু লেখাপত্তর দিন এবার! এক গাল হেসে সুধীরদা সামলে নেন ব্যাপারটা।

- না দাদা, ওটা এখনো কমপ্লিট করে উঠতে পারিনি। হয়ত সামনের বার বেরোবে। আর আপনাদের কথা কী বলব বলুন আমাকে তো চিনতেই পারেন না আজকাল! ছদ্ম-অভিমানে সুধীরদাকে মুখ ভেঙিয়ে ম্যাডাম এবার আমার দিকে চাইলেন। একটু চমকে গেলেন কি? না কি সে আমারই দেখার ভুল!

- আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি বলুন তো?

বাহ্! চিবুকে হাত দিলে তো বেশ লাগে ওনাকে! যাইহোক, এইবার হাসবার পালা আমার। অল্প হেসে বললাম, সেটা নির্ভর করছে দেখবার কালে আমার পরনে সাদা অ্যাপ্রন ছিল কিনা! উত্তরটা যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে খুব সম্ভব কলকাতা মেডিক্যালে। আর যদি নেতিবাচক হয়, তাহলে দাঁড়ান একটু ভাবতে হবে - বলেই আমি ওনার মতো করে চিবুকে হাত দিয়ে দাঁড়াই!

বলাই বাহুল্য, এরপর আলাপ গড়িয়ে পরিচয়ে যেতে বিশেষ দেরী লাগেনি।

হাঁটা শেষ। পৌঁছে গেছি গন্তব্যে। হাতঘড়ি জানান দিচ্ছে তিনটে দশ। কাজেই পাঠক, তার পরের গল্প আজ আর নয়। আসুন ডোরবেলটায় হাত রাখি।

(তিন)

- হ্যাঁ, বলুন?

মেঘা নয়, দরজা খুললেন এক সম্ভ্রান্ত মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা। তাঁকে দেখে অবশ্য একটুও বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয় যে তিনি মেঘার মা। মেঘার চোখদুটো একদম ওর মায়ের থেকে কপি-পেস্ট করা!

- নমস্কার। আপনি আমায় চিনবেন না। আমার নাম পাঞ্চালী মৈত্র। আপনি নিশ্চয়ই মেঘার মা। আমি আসলে ওর জন্য একটা বই এনেছিলাম। এইটে ওকে একটু দিয়ে দেবেন প্লিজ্। সাইড-ব্যাগের চেন টেনে বইটা বের করি আমি।

- ও, আপনিই পাঞ্চালী! ভেতরে আসুন না - আমি ডেকে দিচ্ছি মেঘাকে। ও তো প্রায়সময়ই আপনার গল্প করে।

- পরেরবার নিশ্চয়ই আসব দিদি। আজ একটু তাড়া আছে। কব্জিটা একবার উলটে দেখে নিয়ে বললাম।

- বললেই শুনছি যেন! প্রথমবার মেঘার বাড়ি এলেন আপনি, আর ওর সাথে দেখা না করেই চলে যাবেন? ভদ্রমহিলাও নাছোড়বান্দা।

- সত্যি বলতে কি আমার একটা ফ্লাইট আছে সাড়ে ছটায়। বইটা কেনা ছিল ওর জন্য। হয়ত মৈনাকের হাত দিয়েই পাঠিয়ে দিতাম। আপনাদের বাড়িটা এয়ারপোর্টের রাস্তাতেই পড়ে তাই ভাবলাম। হাসতে হল একটু।

- ওহ্। বেশ। তবে পরেরবার কিন্তু কোন ওজর-আপত্তি শুনছি না, হুমম্!

- মনে পড়ে?

রিকোয়েস্ট অ্যাক্সেপ্ট করার পর ফেসবুকে পিং করেছিল মৈনাক।

না পড়ার তো কোন কারন ছিল না। প্রেসিডেন্সিতে ইংলিশ অনার্স নিয়ে পড়তাম আমরা কজন। আমি তখন চুটিয়ে প্রেম করছি কৃষ্ণেন্দুর সাথে। কৃষ্ণেন্দু। একটা ছোট্ট মফঃস্বল শহর থেকে কলকাতায় পড়তে আসা তুখোড় মেধাবী ছাত্র। কী ভালোই না লিখত। অনার্সের ফাইনাল ইয়ারেই দেশ থেকে ধারাবাহিক উপন্যাস লেখার আমন্ত্রণ। স্যারেরা পর্যন্ত বলতেন বাংলা সাহিত্যের সেরা উঠতি প্রতিভা। অথচ ছেলেটাকে বাস্তব জীবনের দর্পণে ফেলে দ্যাখো, একটি উন্নত প্রজাতির ভ্যাবা গঙ্গারাম! কারো সাথে ঠিক করে কথাটা পর্যন্ত বলতে পারে না। যত ইচ্ছে অপমান টিটকিরি কর - কোন জবাব নেই। ঠাটিয়ে দুটো চড় মারলেও মনে হয়, নিজেই মুখ নামিয়ে স্যরি বলে চলে যাবে! সারাটা কলেজ-লাইফে না কোন আড্ডা, না কোন গ্রূপ। আমি বাদে কারো সাথে কথা আদৌ বলত কিনা তাই বা কে জানে। যুনিভার্সিটির শেষ দিকটায়, ওকে অসহ্য লাগতে শুরু করেছিল। বিরক্তি জমতে জমতে একসময় পাহাড় হয়ে গিয়েছিল আমার।

সাচ এ বোর য়্যু আর, য়্যু নো। আই কানট টেক দিস এনি মোর। শোনো, শুধু প্রতিভা দিয়ে কিছু পাওয়া যায় না আজকের দিনে। একটা ন্যূনতম বাস্তববোধেরও প্রয়োজন। যেটা তোমার পক্ষে, অন্তত এই জন্মে আয়ত্ত করা আর কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টাও করবে না ভবিষ্যতে। বুঝেছো? -এককথায় চার-বছরের সম্পর্কে ইতি টেনে মা-বাবার পছন্দ সায়ন্তনকে বিয়ে করে নিয়েছিলাম আমি। ফ্লোরিডায় চলে এসেছিলাম আমরা। জীবনে পিছনের দিকে হাঁটাটা কোন কাজের কথা না।

একটু কি জোরেই হেঁটে ফেলেছিলাম আমি? নাকি ভুলে গেছিলাম যে, চোখ তুলে নয় হাঁটতে হয় চোখ নামিয়ে রেখে। না হলে সায়ন্তন যখন ক্যাজুয়ালি বলে যাচ্ছিল ওহ্ প্লিজ্ পাঞ্চালী, ডোন্ট বি আ বোর। হোয়াটজ দ্যা বিগ ডিল ইফ শী ইজ্ মাই স্টুডেন্ট! য়্যু আর এ গ্রোন আপ। দিস ইজ ম্যারিকা নাও কাম অন! - আমার ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে করছিল কেন? কেন মনে পড়ে যাচ্ছিল মেট্রোতে ঝাঁপ দিয়ে কৃষ্ণেন্দুর আত্মহত্যার কথা? দ্যাট ওয়াজ নট আ স্যূইসাইড পাঞ্চালী। দ্যাট ওয়াজ আ মার্ডার। য়্যু ব্লাডি য়্যু কিলড হিম। কেন মনে হচ্ছিল যে, আমার প্রবাসী হওয়া আসলে একরকম পালিয়ে আসা। নিজের কাছ থেকে।

থাপ্পড়টা মারার পর আর এক মুহূর্তও দাঁড়িয়ে থাকি নি আমি। সেইদিনই ফিরেছিলাম কলকাতায়। তারপরেও নানাভাবে প্যাচ আপ করতে চেয়েছিল সায়ন্তন! আসলে আমরা কী চাই, নিজেরাই কি জানি ঠিক করে?

দেখতে দেখতে কেটে গ্যাছে আরও পাঁচটা বছর। আমি একটু একটু করে বুড়িয়ে গেছি। অসুন্দর হয়েছি। পরিণত হয়েছি আরও খানিকটা। দিব্যি তো চালিয়ে নিচ্ছিলাম। নিতামও হয়ত। হঠাৎ করে তুমি কেন ফিরে আসলে বলতো? মৈনাক! মৈনাক রায়চৌধুরী মাই ফুট! বললেই আমায় বিশ্বাস করতে হবে তুমি কৃষ্ণেন্দু নও? কেন?

- কী হল! কোথায় হারিয়ে গেলেন? আচ্ছা, আমিই মনে করিয়ে দিই আমাদের গত সপ্তাহে আলাপ হয়েছিল।বইমেলাতে। সেই যে আমি হিমু কিনছিলাম। চটকা ভাঙল মেসেঞ্জারের শব্দে।

- স্যরি মৈনাক। একটু ব্যস্ত আছি আজ। তুমি এক কাজ করো না নেক্সট সানডে, বিকেলের দিকে আমার ফ্ল্যাটে চলে এসো। জমিয়ে আড্ডা দেবো, কেমন? তোমাকে আমার কার্ডটা দেওয়া আছে না?

- আছে। নবনীড়। আচ্ছা বলছিলাম কী আমার এক বন্ধুকে নিয়ে যেতে পারি?

- নিশ্চয়ই এনো! এত কিন্তু কিন্তু করবার কি আছে?

আচ্ছা, বন্ধু শব্দটা কি উভলিঙ্গ? নাকি বান্ধবীর প্রচলন সেকেলে হয়ে গ্যাছে? এমন তো কথা ছিল না কৃষ্ণেন্দু। এ তুমি কাকে নিয়ে এলে? ওহ না আমারই ভুল। তুমি তো মৈনাক রায়চৌধুরী। মেঘা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর হাজব্যান্ড-টু-বি! আচ্ছা একটা কথা বলতো মৈনাক, আমি তো তোমাদের থেকেও তেরোটা বসন্ত বেশি দেখেছি, তবুও মেঘাকে তোমার বাহুলগ্না দেখে আমার ভিতরটা এমন পুড়ে গিয়েছিল কেন? আমার আপত্তি কি এতই মৌন ছিল? আমি তো চিৎকার করে বলেছিলাম - চলে যাও তোমরা এখান থেকে। আর নীচে নামিয়ো না আমায়! খুবই নিঃশব্দ ছিল? মৈনাক?

আমার তো কোন অভিযোগ ছিল না তোমার বিরুদ্ধে। আমি শুধু রাত জেগে কটা বিদেশী যুনিভার্সিটি খুঁজতাম। অ্যাপ্লিকেশন পাঠাবার জন্য। কারণ আমার ঘুম আসতো না। কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম দুজনের একইসাথে থাকার পক্ষে এই শহরটা বড্ড স্বল্প। অনুদার। মৈনাক তুমি তো বিজ্ঞানের ছাত্র। গ্র্যাভিটেশনের অঙ্ক করেছ। কতদূরে বলতে পার মৈনাক, ঠিক কতদূরে গেলে আমাদের মাঝে আর একটুও আকর্ষণ থাকবে না?

তুমি কি বুঝতে না কিছুই? তা হলে বারবার আমার যন্ত্রনা বাড়াতে আমার কাছে আসতে কেন? আমি তো যাওয়ার আগে শেষবারের মতো তোমাদের দুজনকে শুধু নিঃস্বার্থ শুভেচ্ছা জানাতে চেয়েছিলাম। তুমি মেঘাকে সাথে করে নিয়ে আসোনি কেন বল? আমি তো দেবী নই মৈনাক। আমারও তো দুর্বলতা ছিল। আছে।

- ম্যাডাম, আমরা এসে গেছি নামবেন না?

সুমন্ত, আমার ড্রাইভার, দেখলাম হাঁ করে তাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে। কতক্ষন ধরে ডেকে চলেছে কে জানে। আমি অপ্রস্তুত অবস্থাটা চাপা দিতে তাড়াতাড়ি ধমক দিয়ে উঠলাম, আরে নামছি নামছি, তুমি ব্যাগগুলো নামাও তো আগে!

আচমকা একটা কথা মনে পড়ল। এক মুহূর্তের জন্য আমি শ্বাস নিতে ভুলে গেলাম কি? স্বার্থপরের মতো নিজের কথাটুকুই খালি ভেবে চলেছি তখন থেকে। এক্ষুনি আমাকে একটা ফোন করতে হবে।

খোঁজবার প্রশ্নই ওঠে না। কল-লিস্টে সবার ওপরেই থাকে নাম্বারটা।

রিং হয়েই চলেছে।

পিক আপ দ্যা ফোন মৈনাক। পিক আপ দ্যা ফোন য়্যু ইডিয়ট!

(চার)

- উফফ এতবার রিং হওয়ার পর কানে গেল! কোথায় থাকিস তুই? আচ্ছা শোন, এদিকে দারুণ এক কান্ড হয়েছে। তোর সাথে কথা হওয়ার পর খানিক ভেবে-চিন্তে আমিও বেরিয়ে পড়লাম। ওই সাড়ে চারটে নাগাদ। তারপর বেলগাছিয়া পৌঁছে শুনতে পেলাম যে, কী আবার এক ঝামেলা হওয়ায় মেট্রো চলছে না! কী বলবি বলতো একে! বইটা যে করায়ত্ত হোক সেটা বোধহয় ভগবানও চাইছেন না। এসব ভেবে মন খারাপ করে আর বাসও নিলাম না। বাড়ি ফিরে এসে মুখ গোমড়া করে শিব্রাম পড়ছি। এমন সময় গেস হোয়াট? পাঞ্চালীদি এয়ারপোর্টে যাবার পথে, নিজে হাতে বাড়ি বয়ে এসে বইটা দিয়ে গেলেন! জাস্ট ভাবতে পারছিস? ভ্যান গখ! আমার এতদিনের ইচ্ছে! কি যেন বলতিস তুই? হ্যাঁ অভিলাষ! হে হে! হাউএভার শী ওয়জ ইন হারি, তাই আমার সাথে আর হ্যালো হ্যালো তুই কাঁদছিস কেন কী হয়েচ্কে বলছেন? মাসিমা?
 

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password