ভাষা আন্দোলনে ঢাকা কলেজের ছাত্র-শিক্ষকদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা

ভাষা আন্দোলনে ঢাকা কলেজের ছাত্র-শিক্ষকদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী ছাত্রজনতার সংগ্রাম ও বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায় বাংলা। এই ২১শে ফেব্রুয়ারী বা ৮ই ফাল্গুন বর্তমানে প্রতি বছর আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পৃথিবীর সব দেশ একযোগে পালন করে। ১৭ই নভেম্বর ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারীকে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ভাষা আন্দোলনে এই অঞ্চলের প্রথম উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র ঐতিহ্যবাহী ঢাকা কলেজ এর ছাত্র-শিক্ষকদের ছিল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা।

১৯৫২ সালের ২১ফেব্রুয়ারী ঢাকা কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেদিন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সাধারন ধর্মঘট থাকায় ক্রীড়া প্রতিযোগিতার জন্য আর সুষ্ঠু পরিবেশ ছিল না। ছাত্ররা সেদিন খেলাধুলার বদলে ধর্মঘট সফল করার জন্য ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আসে। মিছিল সহকারে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশে যোগ দেয়।

সেই দিনই অর্থাৎ ২১ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ সালে তদানীন্তন প্রাদেশিক আইন পরিষদের বাজেট অধিবেশন ছিল। তখন সংসদ ভবন না থাকায় অধিবেশন বসেছিল জগন্নাথ হলের মিলনায়তনে। ছাত্ররা মিছিল নিয়ে জগন্নাথ হলের দিকে যেতে চাইলে পুলিশ হামলা চালায়। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে ইট পাটকেল ছুড়ে ছাত্ররা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই শহীদ হয় জব্বার ও রফিকসহ ৪ জন এবং আহত হয় অনেকে। এ খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। তৎকালীন নুরুল আমিন সরকার পরিস্থিতি বেগতিক দেখে কারফিও জারি করে। তখন ঢাকা কলেজের মেইন হোস্টেলের সুপার ছিলেন দর্শনের শিক্ষক সাইদুর রহমান। হোস্টেলটি ছিল বেগমবাজার এলাকায় হাসিনবাগ, মোস্তফা হাউস এবং নুপুর ভিলায়। ধরপাকড় শুরু হলে রাতেই সাইদুর রহমানের ৩৭ বেচারাম দেউরির বাসায় আত্মগোপন করে ছাত্র নেতা মতিনসহ বেশ কয়েকজন।                              

 

ঢাকা কলেজের শিক্ষক সাইদুর রহমানের বাড়ীতেই পরিকল্পনা করা হয় পুলিশের নৃশংসতার প্রতিবাদে সারা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার। ঢাকা কলেজের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আশকর আলীর অনুমতি নিয়ে কলেজের সাইক্লোস্টাইল মেশিন ৩৭ নম্বর বেচারাম দেউরিতে নিয়ে শুরু হয় লিফলেট ছাপানোর কাজ। লিফলেটের জন্য চাঁদা সংগ্রহ করা হল। আন্দোলনের জন্য সাধারন বাঙ্গালী সব ধরনের সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত ছিল। ফলে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চালিয়ে নেওয়া ও লিফলেট বিতরনে কোন সমস্যা হয় না। এরই ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে মেনে নিতে বাধ্য হয় শাসকগোষ্ঠী।

 

শহীদ মিনারঃ

১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ শুরু করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা। খুব তড়িঘড়ি রাত্রির মধ্যে সেই নির্মান কাজ সম্পন্ন করে তারা। ‘শহীদ বীরের স্মৃতিতে’ - এই শিরোনামে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ছাপা হয় শহীদ মিনারের খবর। মিনারটি তৈরি হয় মেডিকেলের ছাত্র হোস্টেলের বার নম্বর শেডের পূর্ব প্রান্তে। শহীদ মিনারটি ছিল ১০ ফুট উচ্চ ও ৬ ফুট চওড়া। মিনার তৈরির তদারকিতে ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার শরফুদ্দিন। ডিজাইন করেছিলেন বদরুল আলম। সাথে ছিলেন সাঈদ হায়দার। তাদের সহযোগিতা করেন দুইজন রাজমিস্ত্রী। মেডিকেল কলেজের সম্প্রসারণের জন্য জমিয়ে রাখা ইট, বালি এবং পুরান ঢাকার পিয়ারু সর্দারের গুদাম থেকে সিমেন্ট আনা হয়। ভোর হবার পর একটি কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় মিনারটি। ঐ দিনই অর্থাৎ ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে, ২২ ফেব্রুয়ারির শহীদ শফিউরের পিতা অনানুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে দশটার দিকে শহীদ মিনার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন। উদ্বোধনের দিন অর্থাৎ ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ও সেনাবাহিনী মেডিকেলের ছাত্র হোস্টেল ঘিরে ফেলে এবং প্রথম শহীদ মিনার ভেঙ্গে ফেলে। এরপর সময়ের সাহসী পদক্ষেপ গ্রহন করে ঢাকা কলেজের ছাত্ররা।জীবনের পরোয়া না করে শাসক গোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আন্দোলনের কেন্দ্র ঢাকাতে একটি শহীদ মিনার তৈরি করে। ভাষা আন্দোলনে যা অসীম বীরত্বপূর্ণ ও উতসাহবেঞ্জক হিসেবে কাজ করে।কলেজ প্রাঙ্গনের এই শহীদ মিনারটিও একসময় সরকারের নির্দেশে ভেঙ্গে ফেলা হয়। ১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারীতে প্রথম শহীদ দিবসে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মত ঢাকা কলেজেও নির্মাণ করা হয় শহীদ মিনার। এ প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দেবার জন্য তখনকার ছাত্র ইকবাল আনসারি খান (হেনরি) ও আতিকুল ইসলাম সহ অনেক ছাত্রকে নিয়মতান্ত্রিক শাস্তি ভোগ করতে হয়। অবশেষে, বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেবার পরে ১৯৫৭ সালের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাজ শুরু হয়। এর নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির তত্ত্বাবধানে।১৯৫৬ সালের ২১শে ফ্রেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ রিক্সাচালক আওয়ালের ৬ বছরের মেয়ে বসিরণকে দিয়ে এ স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। বাংলাদেশের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী হামিদুর রহমান মহান ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত শহীদ মিনারের স্থপতি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছেন। তাঁরই রূপকল্পনা অনুসারে নভেম্বর, ১৯৫৭ সালে তিনি ও নভেরা আহমেদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সংশোধিত আকারে শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ কাজ শুরু হয়। এ নকশায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের সম্মুখভাগের বিস্তৃত এলাকা এর অন্তর্ভূক্ত ছিল। ১৯৬৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ ব্যক্তিত্ব আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম নতুন শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন।

 

প্রথম শহীদ মিনার ও একুশের গানঃ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী......’ রচিত হয় ঢাকা কলেজের তৎকালীন কোয়ার্টার ৩৭ বেচারাম দেউরিতে।গানটির রচয়িতা প্রখ্যাত আব্দুল গাফফার চৌধুরী ঢাকা কলেজের শিক্ষক সাইদুর রহমানের বাড়িতে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় এটি রচনা করেন। টাইপ করা হয় ঢাকা কলেজের সাইক্লোস্টাইল মেশিনে।আর তা টাইপ করেন ঢাকা কলেজের তৎকালীন ছাত্র, বর্তমান প্রখ্যাত সাংবাদিক শফিক রেহমান ।এ গানটি একটি খবরের কাগজের শেষের পাতায় একুশের গান শিরোনামে প্রথম প্রকাশিত হয়। তখন গীতিকারের নাম ছাপা হয়নি। পরবর্তীতে অবশ্য গীতিকারের নাম ছাপা হয়। ১৯৫৪ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে সংকলনে প্রকাশিত হয় গানটি। তৎকালীন সরকার সংকলনটি বাজেয়াপ্ত করে।

প্রথমে এটি কবিতা হিসেবে লেখা হয়েছিল। তৎকালীন সময়ে কবিতাটি আব্দুল লতিফকে দিলে তিনি এতে সুরারোপ করেন। লতিফ আতিকুল ইসলাম প্রথম গানটি গান। কিন্তু গানটি ছিল সমবেত সঙ্গীত।আবারো সময়ের সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে ঢাকা কলেজের কিছু ছাত্র কলেজ প্রাঙ্গনে শহীদ মিনার স্থাপনের চেষ্টা করার সময় গানটি গেয়েছিল। একারণে তৎকালীন কলেজ প্রশাসন তাদেরকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করে। পরবর্তীতে আলতাফ মাহমুদ, যিনি সে সময়কার একজন নামকরা সুরকার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, গানটিতে পুনরায় সুরারোপ করেন। বর্তমানে এটিই গানটির প্রাতিষ্ঠানিক সুর হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। গানটি রচয়িতা আব্দুল গাফফার চৌধুরী এবং প্রথম সুরারোপ করেন আব্দুল লতিফ। কিন্তু পরবর্তীতে সুরকার আলতাফ মাহমুদ গানের সুরে পরিবর্তন আনেন। বর্তমানে আলতাফ মাহমুদের সুর করা গানটিই গাওয়া হয়। বিবিসি শ্রোতা জরিপে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গানের তালিকায় এটি তৃতীয় স্থান লাভ করেছে।

 

শেষ কথাঃ

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ সহ সকল আন্দোলনে ঢাকা কলেজ এর ছাত্রদের অগ্রণী ভুমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।বায়ান্ন'র প্রেরনা যার শক্তি জুগিয়ে আসছে।ইনশাআল্লাহ্ ঐতিহ্যবাহী এই কলেজ এর সাহসী ছাত্রদের এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে চিরকাল।

 

তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট, উইকিপিডিয়া, ব্লগ।

 

লেখকঃ মোঃ রাইসুল ইসলাম

বিএসসি (অনার্স) ২০১৩, মাস্টার্স ২০১৪

পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ,ঢাকা।

ইমেইলঃ raisul.physics.dc@gmail.com

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password