কোন পুরুষ প্রথমবার আমাকে দেখতে এসেছেন

কোন পুরুষ প্রথমবার আমাকে দেখতে এসেছেন
MostPlay

জুবুথুবু হয়ে কালো বোরখার আড়ালে বসে আছি আমি। প্রচন্ড নার্ভাস লাগছে। পাত্র সম্পর্কে যা শুনেছি,মনে মনে ঠিক করেই রেখেছি কোন অবস্থায়ই এখানে রাজি হব না!শুনেছি পাত্রের বেশভূষা, চলাফেরা, লাইফ স্টাইল কিছুই দ্বীনের সাথে যায় না!তবু বাবা মায়ের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতেই এই আয়োজন ।তিনি চুপ করে বসে ছিলেন এক কোনায়।

নিক্বাবের আড়ালে আমাকে দেখার উপায় নেই।পাত্রের ভাইয়েরা,আত্মীয়রা কথা বলছেন।প্রশ্ন করছেন।কোন মতে উত্তর দিচ্ছি।রাগও হচ্ছে খুউব।…তিনি ধীর গলায় মা’কে রেখে সবাইকে রুম থেকে বের হতে বললেন।আমি নিক্বাব খুললাম।…তিনিও নার্ভাস ছিলেন ..কোন কথাই বলতে পারলেন না!উঠে যাওয়ার আগ মুহূর্তে আমার চোখ পড়ল তার চোখে।অশ্রুসজল গভীর দু চোখ।মাত্র কয়েক সেকেন্ড..!

আমার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল অদ্ভূত এক ভাললাগায়..!কেন?তা তো জানি না!চোখে চোখ না পড়লে হয়ত আমার জন্য সহজ হত শক্তভাবে পছন্দ হয়নি বলার।কিন্তু আমি অসম্মতি জানাতে পারিনি।আর তিনিই বা কেন আপাদমস্তক কালো বোরখায় আবৃত আমাকে পছন্দ করলেন,জানিনা!রাসূল(স) এর কথা মনে পড়ল, “তুমি তাকে দেখে নিবে,তোমার এ দর্শন তোমাদের মাঝে দাম্পত্য জীবনের প্রণয়-ভালবাসা সৃষ্টিতে সাহায্য করবে” (তিরমিজি)

তাই হল কি?আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার উপর সব ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে রইলাম।তিনি যা ভাল মনে করবেন তাই হোক।বিয়ে ঠিক হয়ে গেল।বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাকে দেখে মনে হয় দ্বীনের কোন বুঝই হয়ত নেই।এই মানুষটার কোন কিছুই যেন আমার পছন্দের সাথে মিলে না।তার এফবি আইডিতেও নেই কোন ইসলামিক কিছু শেয়ার,কিংবা কোন হৃদয় ছোয়া পোস্ট!..অথচ আমি সব সময় দুয়া করেছি আল্লাহ যেন আমাকে উত্তম জীবন সংগী দান করেন।যিনি রাসূলের সুন্নাহ ভালবেসে গ্রহণ করবেন, এমন একজন মানুষ যাকে দেখেলেই আমার ঈমান মজবুত হবে…।অথচ…!

বিয়ে ঠিক হওয়ার পর অবশ্য খুব পোড়াচ্ছিল তার ক্লিনশেভ মুখটা।বারবার মনে হচ্ছিল আমি কি ভুল করছি..কোন বিপদ ডেকে আনছি না তো…!এমন পরিবারে দ্বীন পালন করা আর যুদ্ধ করা সমান মনে হল!যদিও ইস্তেখারার রেজাল্ট পজিটিভ পাচ্ছিলাম।আল্লাহ ভরসা!নিশ্চয়ই আমার জন্য যা কল্যাণকর তাই হবে।নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম।

বিয়ের আগে খবর পাঠালাম; পার্লারে সাজব না,ঘরে থাকব,পর্দা মেইনটেইন করব,কোন ধরনের ছবি বা ভিডিওতে আমাকে যেন এড করা না হয়।জানালেন,”কোন সমস্যা নেই।তিনিও তাই চান!”এত সহজে রাজি হয়ে যাবেন ভাবিনি! শুনে খুব খুশি হলাম।বিয়ের দিন তিনি তার কথা রেখেছেন। সবার বিরুদ্ধে যেয়ে আমাকে সাপোর্ট করেছেন।এই তো চেয়েছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ।

গাড়ি চলছে শশুরবাড়ির পথে।তিনি আমার পাশে বসা।৬ মাস আগে কয়েক সেকেন্ড দেখেছিলাম,চেহারাটাও ঠিক মনে নেই!তিনি আমার নীরব কান্না দেখে বললেন,”আপনি কাঁদছেন আমার খুব কষ্ট হচ্ছে,মন ভাল করুন।আপনার যখন ইচ্ছা হবে বাবার বাসায় যাবেন,আমার অনুমতিও নিতে হবে না!”আমার হাত আলতো করে ধরলেন, আমি দ্বিতীয়বারের মত তার দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম! গাল ভরা সুন্নতি দাড়ি!তিনি মিটিমিটি হাসছেন! মনে হল প্রথম দেখার সেই মানুষটি নন,যেন অন্য কেউ পাশে বসা!আরো উত্তম কেউ..!আবার কেঁপে উঠলাম সে-ই অদ্ভুৎ ভালবাসায়..ভাললাগায়..! বেদনার অশ্রু এবার গড়িয়ে পড়ল আনন্দে…! আলহামদুলিল্লাহ।

গাড়ি মাঝপথে জ্যামে আটকে থাকে…আমার ভাললাগে।তার-ও। বললেন,”এই প্রথম জ্যাম টাও বেশ ভাললাগছে..!”বাসায় ঢুকার আগ মুহূর্তে অভয় দিলেন,”সব সময় আপনার পাশে আছি।আল্লাহ আপনার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন,এ দায়িত্বের কোন অবহেলা হবে না।ইন শা আল্লাহ”।

রাত গভীর হচ্ছে… তিনি গল্প বলছেন। মুগ্ধ হয়ে শুনছি আর শুনছি।মনেই হচ্ছে না মানুষটা আমার জীবনে নতুন কেউ,আমার প্রথম রাত একজন অপরিচিতের সাথে…! মনে হচ্ছে যেন বহু বছরের পরিচিত এক পরম বন্ধুর সাথে গল্প করছি। তিনি জানালেন তার সৌভাগ্য আমাকে পেয়েছেন, কল্পনা করেননি আল্লাহ এমন নেয়ামত দিবেন। যদিও সব সময় দুয়ায় তাই চেয়েছেন। জানালেন, এ জীবন পরিবর্তন করতে চান।আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে থাকতে চান। খুব করুণ স্বরে বললেন, “আমি আমার রবকে চিনতে চাই, আপনি কি আমাকে সাহায্য করবেন?”

আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে…!এত গভীর অনুভব তো আমি আমার রবের জন্য করতে পারি না!আমি তো কখনো আমার রবকে এভাবে চেনার কথা ভাবিনি!নিজের দুর্বলতার কথা বলি তাকে।তিনি আমাকে যা ভাবছেন তা তো আমি নই।আমিও যে আমার রব কে চিনিনি এখনো!বারবার দূরে সরে যাই..! আমারো যে সাহায্যের বড় প্রয়োজন!…
আমরা দু’জন দু’জনকে সাহায্য করার নিয়তে রবের দরবারে হাত তুলি। তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করে শুকরিয়া জ্ঞাপন করি।এ জীবন তো খুবই স্বল্প সময়ের…আমরা যে চিরস্থায়ী জান্নাতে একে অপরকে পাশে চাই!..

ঘর ভর্তি আত্মীয়-স্বজন তাই প্রতিবেলায় যত্ন করে তিনি আমাকে খাবার খাইয়ে দেন, গল্প শুনান ঠিক যেমনটা ছোটবেলায় আমার বাবা শোনাতেন..! মসজিদে সালাত পড়ার সময়টুকু ছাড়া আর সব সময় পাশে থাকেন যেন নতুন পরিবেশে কোন অস্বস্তি অনুভব না করি। আমার চোখে ঘোর লাগে। আরশের অধিপতির প্রতি সিজদায় পড়ি বারবার।

সন্ধ্যা রাতে আমরা কুরআনের আয়াত নিয়ে আলোচনা করি,এক একটা অর্থ বোঝার চেষ্টা করি।আল্লাহর মাহাত্ম্য-বড়ত্বের পরিচয় জেনে বিষ্মিত হয়।কত মহাজ্ঞানী আমাদের মহান আল্লাহ!অনুভব করে সিজদায় মাথা নত করি। তার মুখে নবী-রাসূলদের কাহিনী, সাহাবাদের কাহিনী মুগ্ধ হয়ে শুনি। এত সুন্দর করে আর কেউ কখনো এভাবে বলেনি।আলহামদুলিল্লাহ।

মাঝে মাঝে আমরা ঘরে জামাতে সালাত আদায় করি। সালাতে তার গভীর আবেগে উচ্চারিত সূরাগুলো শুনে আবেগসিক্ত হই।হৃদয় দিয়ে যা পড়া হয়,তা তো হৃদয় ছুঁতে বাধ্য আর তা যদি হয় আল্লাহর ক্বালাম তবে হৃদয় দুমড়ে মুচড়ে যাওয়াই তো স্বাভাবিক..!হাউমাউ করে কান্নায় ভেংগে পড়ি।…

বাহ্যিকভাবে দেখে তাকে নিয়ে কত কীই না ভেবেছিলাম।অথচ তিনি বাবা মায়ের হকের ব্যাপারে যেমন খেয়াল করেন,তেমনি আত্মীয়-স্বজন৷ প্রতিবেশীদেরও খবর রাখেন।তিনি এই হাদীসের উপর আমল করেন,”তোমাদের মধ্যে সেই ব্যাক্তি উত্তম,যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম”।তিনি আমার হক মর্যাদার প্রতি সব সময় সতর্ক থাকেন।আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা,পছন্দ-অপছন্দের প্রতি খেয়াল রাখেন।আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ তাকে দুনিয়া ও আখেরাতে উত্তম থেকে উত্তম বিনিময় দান করুন।আমীন।

আমরা দু’জন সীরাতুল মুস্তাকীমের পথে হাঁটতে চাই,আমাদের রবকে চিনতে চাই।সমস্ত প্রশংসা তো সেই মহান রবের প্রতি যিনি মানুষের হৃদয়ে একে অপরের প্রতি ভালবাসার সৃষ্টি করেন, সূকুন দান করেন তার অফুরন্ত নেয়ামত দ্বারা।তোমার শোকর হে আল্লাহ।তোমার শোকর।

“ইয়া মুক্বালিব্বাল ক্বুলুব,সাব্বিত ক্বালবি,আলা দ্বীনিক।”(ও অন্তর সমূহের নিয়ন্ত্রণকারী,আমার অন্তরকে তোমার দ্বীনের উপর স্থীর করে দাও।”)

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password